রতন রায়হান, রংপুর।কুরিয়ার সেবা বলতে এক সময় মানুষ বুঝতো শুধুই চিঠিপত্র বা গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র আদান-প্রদান। গেল এক দশকে সেই ধারণা পুরোপুরি বদলে গেছে। ই-কমার্সে কেনাকাটা বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্য পরিবহনে গুরুত্ব বেড়েছে কুরিয়ারের। ডিজিটালাইজেশন তথা স্মার্ট ফোন, ইন্টারনেট, অ্যাপভিত্তিক কেনাবেচায় গত ছয় বছরে বাজারে এসেছে শতাধিক অনলাইন বা অ্যাপভিত্তিক ই-কুরিয়ার কোম্পানি। এমনই একজন উদ্যোক্তা কে এম রিদওয়ানুল বারী জিয়ন।
জিয়নের প্রতিষ্ঠানের নাম স্টেডফাস্ট। ইতোমধ্যেই নিজের এই উদ্যোগ নিয়ে বেশ সফলও হয়েছেন তিনি। দৈনিক ডেলটা টাইমস কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই তরুণ উদ্যোক্তা জানিয়েছেন তার নিজের পথচলা ও স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের শুরুর গল্প।
প্রতিবেদক: আপনার ছোটবেলা সম্বন্ধে বলুন।
জিয়ন: আমার বেড়ে ওঠা রংপুর জেলার গংগাচড়া উপজেলায়। এসএসসি পাস করেছি গংগাচড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। এইচ এস সি রংপুর বিয়াম মডেল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসেফিক থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক সম্পন্ন করেছি।
প্রতিবেদক: Steadfast Courier এর শুরুটা কীভাবে হয়েছে এবং এর কার্যক্রম নিয়ে কিছু বলুন।
জিয়ন: স্টেডফাস্টের শুরুটা হয়েছিলো ২০১৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। মাত্র ৫ জন ডেলিভারিম্যান নিয়ে শুরু হয় পথচলা। আমরা তখন যে বাসায় থাকতাম সে বাসারই একটা রুম থেকেই যাত্রা হয় স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের। স্টেডফাস্ট শুরুর আগে আমি একটি ই-কমার্স বিজনেস করতাম। কিন্তু সে সময় ই-কমার্স ফ্রেন্ডলি তেমন কোন কুরিয়ার ছিল না। দুই একটা থাকলেও তাদের সার্ভিসের বেহাল দশা ছিল। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতেই একটি ই-কমার্স ফ্রেন্ডলি কুরিয়ার শুরুর কথা মাথায় আসে এবং সেখান থেকেই স্টেডফাস্টের যাত্রা শুরু। কিন্তু ৫জন রাইডার নিয়ে প্রথম দিকে সার্ভিস চালানো সহজ ছিল না। আমরা সময়ের সাথে সাথে রাইডার বাড়াতে থাকি এবং আমাদের কভারেজ এরিয়া বাড়াতে থাকি। এভাবেই চলছে এখনো।
প্রতিবেদক: উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল?
জিয়ন: আমার সবসময় চিন্তা ছিল প্রথাগত চাকুরির বাইরে গিয়ে কিছু করা। এজন্য ছাত্রাবস্থায় ২০১২ সাল থেকেই আমরা ফ্রীল্যান্সার হিসেবে বিভিন্ন মার্কেটপ্লেসে কাজ করেছি। আমি যদিও ইইই এর ছাত্র তবু আমি আমার সাবজেক্টের বাইরে গিয়ে ওয়েব ডিজাইন ও ডেভেলপমেন্ট শিখি এবং এর উপর দক্ষতা বাড়াতে থাকি। ফ্রীল্যান্সিং করা অবস্থায় একটা ব্যবসা করার চিন্তা মাথায় আসলো। সে কারণেই একটি ই-কমার্স শপ ওপেন করেছিলাম ২০১৪ এর জানুয়ারিতে। সেই ই-কমার্স শপ সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ডেলিভারি সার্ভিস। সে সমস্যাটি সমাধানের লক্ষ্যেই আমি ই-কমার্স ডেলিভারি সার্ভিস শুরু করার সিদ্ধান্ত নেই।
প্রতিবেদক: প্যান্ডেমিকের সময়টায় কীভাবে কাজ করেছেন?
জিয়ন: প্যান্ডেমিকের সময়টা আমাদের জন্য মিশ্র অভিজ্ঞতার ছিল। এ ধরণের অভিজ্ঞতা যেহেতু এর আগে কখনও ছিল না, তাই শুরুর দিকে আমরা কিছুটা হোঁচট খেয়েছিলাম। এরপর মাস-খানেকের মধ্যে আমরা ঘুরে দাঁড়াই এবং লক-ডাউনের সময় ঘরে ঘরে সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করি। প্যান্ডেমিকের প্রথম দিকে আমাদের রাইডার সর্টেজ থাকলেও পরে এই সমস্যা আমরা দ্রুত কাটিয়ে উঠি। এছাড়া প্যান্ডিমিকের সময় যারা কাজ হাড়িয়েছিলো আমরা তাদের জন্য আমাদের কুরিয়ারে চাকুরির ব্যবস্থা করি। প্যান্ডেমিকের সময় আমরা আমাদের রাইডার ও স্টাফদের জন্য বিভিন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করে সার্ভিস চলমান রাখি। কোন রাইডার বা স্টাফের করোনা সিম্টমস দেখতে পেলেই আমরা তাদের আইসোলেটেড করে রাখতাম। তাদের জন্য আলাদা থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। এছাড়া প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হতো।
প্রতিবেদক: আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট নিয়ে কিছু বলুন।
জিয়ন: আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল আমার সহধর্মিণী জোয়াইরিয়া মোস্তারীকে জীবন সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নেয়া। এ কারণে আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই কিছু করার তাগাদা পাই। যার কারণে নিজের সেরাটা বের করার চেষ্টা করি আমি। আর আমার এই চলার পথে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা পাই তার কাছ থেকেই। আমাদের কুরিয়ারের শুরু থেকেই সে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। বর্তমানে সে আমাদের কুরিয়ারের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছে।
প্রতিবেদক: তরুণদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ কী দেবেন?জিয়ন: তরুণদের উদ্দেশ্যে আমি বলবো, তারা যেন নিজেদের কোন বিষয়ে স্কিল্ড হিসেবে তৈরি করে। ইংরেজি ভাষাটা যেন মোটামুটি ভালোভাবে রপ্ত করে, আইটি স্কিল যেন বৃদ্ধি করে এবং কোন কোন বিষয়ে নিজেকে এক্সপার্ট করে তৈরি করে। আগামীতে সবকিছুই টেক নির্ভর হতে যাচ্ছে। এখানে ভালো করতে গেলে আমাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। শুধু মাত্র সার্টিফিকেটের জন্য পড়াশুনা না করে কিছু শেখার জন্য যেন তারা পড়াশুনা করে।
প্রতিবেদক: ৫ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?জিয়ন: আগামী ৫ বছরের মধ্যে স্টেডফাস্টকে বাংলাদেশের টপ কুরিয়ার হিসেবে পরিণত করতে চাই এবং বাংলাদেশে ২০-৩০ হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই।
প্রতিবেদক: আপনার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন।জিয়ন: এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য স্টেডফাস্ট কুরিয়ারের সার্ভিস দেশের আনাচে কানাচে পৌঁছে দেয়া। টপ টেকনোলজি ব্যবহার করা। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বহির্বিশ্বেও স্টেডফাস্টের সার্ভিস যেন পৌঁছে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এছাড়া ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো।
0 coment rios: