বাগেরহাট প্রতিনিধিঃবাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার ৩০৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা কেনার নামে লাখ লাখ টাকা আত্নসাত হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের স্লিপের বরাদ্দ থেকে
ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে প্রায় ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছে একটি চক্র। উপজেলার স্ব-ঘোষিত কতিপয় শিক্ষক নেতা ও
শিক্ষা অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন না কিনেই ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যেমে এ টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। পরে বিভিন্ন দিক থেকে অভিযোগ উঠলে অবস্থা
বেগতিক দেখে সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন কেনার হিড়িক পড়ে। নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত নিম্নমানের হাজিরা মেশিন কেনার উদ্যোগ
নেয় ওই চক্র। আর এ মর্মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর একটি অভিযোগ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। তার এ অভিযোগের
ভিত্তিতে তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগের তদন্ত শেষে এর সত্যতা পেয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে স্লিপের বরাদ্দ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ডিজিটাল হাজিরা নিশ্চিতের জন্য বায়োমেট্রিক
হাজিরা মেশিন কেনার নিদের্শ দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর এ নির্দেশনা পেয়ে প্রধান শিক্ষকরা ওই অর্থ বছরের স্লিপের বরাদ্দ
থেকে হাজিরা মেশিন কিনে ভাউচার উপস্থাপন করেছেন। স্লিপের বরাদ্দের কেনা কাটায় উপজেলা শিক্ষা অফিস সরাসরি জড়িত থাকে না। স্ব-স্ব
বিদ্যালয়ে নিজেরাই ¯িøপের মালামাল ক্রয় করে থাকে এবং প্রতিটি বিদ্যালয়ে স্লিপের ক্রয় সংক্রান্ত আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে।
উপজেলার অন্তত ২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে কোথাও ডিজিটাল হাজিরা মেশিন বসানো দেখা যায়নি। অধিকাংশ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছাড়া অন্য শিক্ষকরা ডিজিটাল মেশিন কিনে বিল ভাউচারের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে এ তথ্যই জানেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও কয়েকজন শিক্ষক বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের পরেও তিনটি অর্থ বছর পেরিয়ে গেছে, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন কেনা হয়নি। এমনকি বরাদ্দ ফেরতও দেওয়া হয়নি। অনেক প্রধান শিক্ষক স্কুল থেকে বদলী হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।
কোনো কোনো প্রধান শিক্ষক অবসরে চলে গেছেন। বিষয়টি যে কারো কাছে অবশ্যই আত্মসাতের সামিল বলে মনে হবে।
সরকারি কোন টাকা উত্তোলনের পরে খরচ করতে জটিলতা তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে তা সরকারী কোষাগারে ফেরৎ দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু তিন অর্থ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের পক্ষে সহকারী জেলা শিক্ষা অফিসার শেখ
আব্দুল গনি স্বাক্ষরিত ২৬/৭/২০২১ তারিখের পত্র যার স্মারক নং জেপ্রাশিকা/বাগের/৪৫০-এ মোরেলগঞ্জে ৩০৯ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
হাজিরা মেশিন ক্রয়ের নামে জাল বিল আউচার দাখিল করা হলেও অদ্যাবধি তা ক্রয় করা হয়নি উল্লেখ করে মোরেলগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে এ মর্মে নির্দেশ প্রদান করেন যে-২৯/৭/২০২১ তারিখের মধ্যে বায়োমেট্রিক হাজিরা মেশিন ক্রয় বাবদ উত্তেলিত অব্যয়িত অর্থ
চালানের মাধ্যমে জমাদান করতে।
এব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার ‘চিঠি দিয়ে শিক্ষকদের জানানো হয়েছে’ বললেও প্রধান শিক্ষকরা ‘ অবহিত নন’ বলে জানান।
এদিকে, সরেজমিনে দেখো গেছে, ওই তারিখের পরে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক বায়োমেট্রিকের ক্যাশমেমো সংগ্রহ করেছেন। কারো কারো ভাউচার রয়েছে তারিখ বিহীন। অনেকের ধারণা ওই
ভাউচারে পরবর্তীতে সুবিধাজনক তারিখ বসানো হবে।
এদিকে অধিকাংশ প্রধান শিক্ষকরা জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিসে আধিপত্য বিস্তারকারী কতিপয় শিক্ষক নেতারা তাদের কথিত ইউনিয়ন
ভিত্তিক গুচ্ছ শিক্ষক নেতাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে মেশিন পৌঁছে দিয়ে টাকা গ্রহণ করে। সরেজমিনে দেখা গেছে, তাদের
সরবরাহকৃত মেশিন ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার টাকা বাজারমূল্যের। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সলিড ওয়ার্কস কর্তৃক ১০৯ নং সুতালড়ি
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেমোতে উল্লেখ আছে ডিভাইস ‘আইক্লক ৯০০জি’ যার মূল্য দেখানো হয়েছে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ যার বাজার মূল্য রয়েছে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। প্যাকেট খুললে দেখা গেছে ‘জেডকে টেকো বায়োটাইম ৮.০’ এর মূল্য ৪ হাজার ২০০ টাকা। সফ্টওয়ার, ইন্সটলেশন, ডাটাচার্জ সহ আনুসঙ্গিক খরচ
দেখিয়ে নেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার টাকা। নিম্নমানের বলে প্রধান শিক্ষকরা নিতে নারাজ হলেও কথিত নেতাদের চাপের মুখে অবশেষে নতি
স্বীকার করেন। বায়োমেট্রিক মেশিন না কিনে কিভাবে ভাউচার জমা হলো এবং তা
পাশ করানো হলো- এ প্রশ্নের উত্তরে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ জালাল উদ্দিন বলেন, স্টারভিংসে (নির্দেশনা) ঝামেলা ছিল যার সংশোধনী
এসেছে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এবং তার পরের বিলম্বের কারণ হিসেবে তিনি ‘করোনাকে’ সামনে আনলেন। তবে মেশিনের মান নিয়ে প্রশ্ন
করা হলে তিনি বলেন, সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী-ই তারা কিনেছেন এবং কেনার কথা।’
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষক নেতা হারুন অর রশিদ
বললেও এক প্রশ্নের জবাবে সরবরাহকৃত মেশিনের এক-তৃতীয়াংশ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানান।
উল্লেখ্য, বাগেরহাট-৪ মোরেলগঞ্জ-শরণখোলা) আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডঃ আমিরুল আলম মিলন এর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে লিখিত এক
অভিযোগের ভিত্তিত্বে গত বৃহস্পতিবার ( ১০ নভেম্বর) প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট) শেখ মোঃ রায়হান উদ্দিন
বাগেরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ শাহ আলমকে সঙ্গে নিয়ে এ অভিযোগের তদন্তে আসেন।
এব্যাপারে ভুক্তোভোগী শিক্ষক এবং সচেতন মহলের দাবি- সরকারী অর্থ
আত্নসাত চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

0 coment rios: